রাত সোয়া ১২টার সময় এ বিষয়ে জানতে যোগাযোগ করা হলে শাহবাগ থানার ডিউটি অফিসার এসআই ভজন জানান,‘সুপ্রিম কোর্ট আমাদের থানা এলাকা হলেও এ বিষয়ে কেউ কিছু আমাদের জানায়নি। থানাও বিষয়টি সম্পর্কে অবগত নয়। সেখানে বাড়তি কোনও পুলিশও নিরাপত্তার জন্য দায়িত্ব পালন করছে না বলেও জানান তিনি।’
এ সময় সাংবাদিকদের অনুরোধে গণমাধ্যমের মুখোমুখি হন ভাস্কর্যটির নির্মাতা মৃণাল হক। তিনি জানান, ‘আমাকে এ বিষয়ে গতকাল (বৃহস্পতিবার) জানানো হয়েছে। ভাস্কর্য সরিয়ে হয়তো অ্যানেক্স ভবনের সামনে স্থাপন করা হতে পারে।’ তিনি আরও বলেন,‘আমাকে এটা সরানোর জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তাই আমি এখানে এসেছি।’
রাত ১টায় বাংলা ট্রিবিউনের কথা হয় অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমের সঙ্গে।তিনি জানান,প্রধান বিচারপতির নির্দেশেই ভাস্কর্যটি সরানোর কাজ চলছে।
তিনি আরও জানান,‘‘বৃহসস্পতিবার বিকেলে প্রধান বিচারপতি তাকে ডেকে পাঠান। তার কক্ষে গিয়ে ড.কামাল হোসেন,খন্দকার মাহবুব হোসেনসহ সুপ্রিম কোর্টের বারের বর্তমান ও সাবেক দায়িত্বশীলদের সেখানে দেখতে পান তিনি। সবার উপস্থিতিতে প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘সুপ্রিম কোর্টের সামনের ভাস্কর্যকে কেন্দ্র করে আমি কোনও অপ্রীতিকর ঘটনা চাই না। এটি সরিয়ে নেওয়া হোক এবং এমন জায়গায় স্থাপন করা হোক যেন প্রশ্ন না ওঠে ।’এরপর সবার মতামত জানতে চান তিনি।’’
অ্যাটর্নি জেনারেল আরও জানান, ‘এসময় সুপ্রিম কোর্টের সামন থেকে ভাস্কর্যটি সরিয়ে নেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ বলে আমরা প্রধান বিচারপতিকে বলেছি।’
এরপরেই প্রধান বিচারপতি এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দেন বলেও জানান অ্যাটর্নি জেনারেল।
এদিকে ভাস্কর্যটি অপসারণের কাজ চলার সময় ব্যথিত কণ্ঠে মৃণাল হক গণমাধ্যমকর্মীদের আরও বলেন, ‘আমার কিছু বলার নাই।অনেকের অনেক ক্ষমতা আছে। আমি বানিয়েছি, আমাকে সরাতে বলা হয়েছে।আমি তদারকি করছি।’কান্না জড়িত কণ্ঠে তিনি আরও বলেন, ‘এসব বলতে গেলে বিপদ। এর আগে আমার বানানো লালনের ভাস্কর্য ভাঙা হয়েছে। আমাকে গতকাল জানান হয়েছে।’
এ ভাস্কর্যকে গ্রিক দেবী থেমিসের প্রতিকৃতি বলা হলেও ভাস্কর্যটির নির্মাতা তীব্র আপত্তি করে বলেন, ‘এ ভাস্কর্য কোনও গ্রিক দেবীর নয়।এটি সম্পূর্ণ বাঙালি মেয়ের ভাস্কর্য।শাড়ি-ব্লাউজ পরা একজন বাঙালি নারীকে উপস্থাপন করা হয়েছে এ ভাস্কর্যে। আর এখানে দাড়িপাল্লা বিচারের প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে।’ সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলার সময় আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন মৃণাল হক।
এদিকে, মৃণাল হকের ভাষ্য অনুযায়ী দেখা যায়,সুপ্রিম কোর্টের অ্যানেক্স ভবনের সামনে মাটি খুঁড়ে ভাস্কর্যটি সেখানে সরিয়ে নেওয়ার প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। তবে মাঝপথে অজ্ঞাত কারণে সে প্রস্তুতির কাজ মুলতবি রেখে শ্রমিকরা সেখান থেকে সরে যান।
অন্যদিকে, ভাস্কর্যটি সরিয়ে নেওয়ার কাজ চলা শুরু হতে না হতেই প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানায় হেফাজতে ইসলাম। হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক মাওলানা আজিজুল হক ইসলামাবাদী বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী ওলামা কেরামকে আস্থা ও ভরসা রাখতে বলেছিলেন। প্রধানমন্ত্রীর কথা প্রতিফলন ঘটেছে, সেজন্য তাকে ধন্যবাদ। দেশের মানুষের ধর্মীয় চেতনা বোধকে মূল্য দিয়ে মূর্তি সরিয়ে ফেলা হচ্ছে। সরকারে শুভ বুদ্ধির উদয় হয়েছে। মূর্তি নিয়ে দেশকে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি থেকে রক্ষা করেছে সরকার।’
এদিকে, ভাস্কর্য সরানোর প্রতিবাদে রাতেই সুপ্রিম কোর্টের সামনে বিক্ষোভ করে শাহবাগের আন্দোলনকারী পরিচয়ে গণজাগরণ মঞ্চের একাংশের কিছু কর্মী,ছাত্র ইউনিয়ন, উদীচীসহ আরও কিছু ছাত্র ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের নেতা-কর্মীরা।
বিক্ষোভকারীদের পক্ষে উদীচী শিল্পী গোষ্ঠীর সম্পাদক মণ্ডলীর সদস্য আরিফ নূর বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমরা রক্ত দিয়ে যে স্বাধীনতা অর্জন করেছি, আজকের এ ঘটনা স্বাধীনতার সঙ্গে প্রতারণা। হেফাজতের কথা শুনে তারা এ প্রতারণার কাজ করছে।’
একইসঙ্গে ভাস্কর্যটি অপসারণের খবর ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকেও তীব্র ক্ষোভে ফেটে পড়েন অ্যাক্টিভিস্টরা। এটিকে কালো দিন বলেও অভিহিত করেন কেউ কেউ।
রাত চারটা ২০ মিনিটের দিকে একটি ট্রাকে করে দেবী থেমিসের ভাস্কর্যটি সুপ্রিম কোর্টের অ্যানেক্স ভবনের দিকে নিয়ে যাওয়া হয়।এসময় ভাস্কর্য কোথায় প্রতিস্থাপন করা হচ্ছে জানতে চাইলে ভাস্কর মৃণাল হক ‘বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘কিচ্ছু জানি না। জানি না। আজকে স্থাপন হচ্ছে কি না, তাও জানি না।’ বাংলা ট্রিবিউনের হাতে আসা একটি এক্সক্লুসিভ ভিডিওতে দেখা যায়, প্রথমে ভাস্কর্যটি অ্যানেক্স ভবনের আন্ডারগ্রাউন্ডে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু সেখানে ভাস্কর্যটি রাখার জন্য যথেষ্ট জায়গা না থাকায় তা বের করে অ্যানেক্স ভবনের পানির পাম্পের কাছে নীলরঙা ত্রিপল দিয়ে ঢেকে রাখা হয়।
প্রসঙ্গত, ২০১৬ সালের শেষ দিকে গ্রিক দেবীর ভাস্কর্যটি সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে স্থাপন করা হয়। এরপর প্রায় দুই মাস এ বিষয়ে পক্ষে-বিপক্ষে কোনও মত প্রকাশ না হলেও ফেব্রুয়ারিতে মুখ খোলেন হেফাজতে ইসলামের আমির শাহ আহমদ শফী। এক বিবৃতিতে তিনি সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণ থেকে ভাস্কর্যটি অপসারণের দাবি জানান।
এরপর থেকে ধারাবাহিকভাবে বাংলাদেশের অধিকাংশ ধর্মভিত্তিক সংগঠন ভাস্কর্যটি সরানোর দাবিতে আন্দোলন করছিল। হেফাজতের ঘোষণা ছিল, অপসারণ করা না হলে শাপলা চত্বরে আবারও সমাবেশ করবে তারা।আর সরকারি দলের সহযোগী সংগঠন দাবিকারী আওয়ামী ওলামা লীগের নেতারা সরকারকে হুঁশিয়ারি দেন,সুপ্রিম কোর্টের সামনে স্থাপিত ভাস্কর্যটি সরানো না হলে কেউ জাতীয় ঈদগাহে ঈদের নামাজ পড়তে যাবেন না।
মূলত সুপ্রিম কোর্টের ঠিক পাশে জাতীয় ঈদগাহের অবস্থান হওয়ায় কোর্ট প্রাঙ্গণে স্থাপিত দেবী থেমিসের আদলে বানানো ভাস্কর্যটি নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। কারণ, ঈদগাহ থেকে ভাস্কর্যটি স্পষ্টভাবে দেখা যায়। এ নিয়ে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীও একাধিকবার মন্তব্য করেন। গত এপ্রিল মাসে জাজেস ভবন উদ্বোধনের সময় তিনি প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহাকে ভাস্কর্যটি স্থানান্তর করার অথবা ঈদের নামাজের সময় ভালোভাবে ঢেকে দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন।পরে মন্ত্রিসভা বৈঠকে এবং প্রকাশ্য সভায় প্রধানমন্ত্রী একই বিষয় নিয়ে কথা বলেন এবং ভাস্কর্যটি গ্রিক আদলে নির্মাণ করা হলে এটিকে কেন শাড়ি পরানো হয়েছে সে বিষয়েও প্রশ্ন তোলেন।
মূলত গত ১১ এপ্রিল গণভবনে অনুষ্ঠিত আলেম সমাবেশে দেওয়া বক্তৃতায় কওমি মাদ্রাসার দাওরায়ে হাদিসের সরকারি স্বীকৃতি দেওয়ার পাশাপাশি হেফাজতে ইসলামের আামির মাওলানা শফি আহমেদের ভাস্কর্যটি নিয়ে মন্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে বিষয়টি নিয়ে প্রথম মন্তব্য করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী।
এদিকে,বৃহস্পতিবার সকালেও বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন রমজানের আগেই ভাস্কর্য সরানোর আহ্বান জানিয়েছিল।এর আগে ইসলামী ঐক্যজোট হরতালের ঘোষণা দিয়ে বলেছিল রোজা শুরুর আগে গ্রিক দেবী না সরালে তারা কঠোর কর্মসূচি দেবে। এছাড়াও অব্যাহত হুমকি আসে কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক রাজনৈতিক দল, আওয়ামী ওলামা লীগসহ সুন্নীপন্থী একাধিক সংগঠনের তরফে।উদ্ভূত এই সাংঘর্ষিক পরিস্থিতি এড়াতেই প্রধান বিচারপতি এ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বলে মনে করা হচ্ছে। যদিও ভাস্কর্যরক্ষার দাবিতে দেশের প্রগতিশীলদের একটি অংশ বক্তব্য-বিবৃতি দিয়ে আসছিল।আর আজ শুক্রবার সকাল ১০টায় ভাস্কর্যটি পুনঃস্থাপনের দাবিতে সুপ্রিম কোর্টের সামনে অবস্থান কর্মসূচির ঘোষণা দিয়েছে প্রতিবাদী একাধিক সংগঠন।
আমরা সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।